দশদিন হলো রাকিবের বিয়ে হয়েছে। নিজে পছন্দ করে না, পারিবারিক ভাবেই বিয়ে হয়েছে। নতুন বৌ রাকিবের বেশ পছন্দ হয়েছে। টানা টানা চোখ ছিপছিপে শ্যামলা রঙের মেয়ে সেতারা। রাকিবের বাজারে বইয়ের দোকান আছে। বিয়ের আগে রাকিব সকালে খেয়ে দুপুরের জন্য খাবার সাথে করে নিয়ে যেত কিন্তু বিয়ের পর নতুন বউকে দেখার জন্য দুপুরে বাড়ি এসে ভাত খাচ্ছে। বউয়ের মুখের একটু হাসি দেখার জন্য রাকিব দুই মাইল সাইকেল চালিয়ে দুপুর রোদে বাড়ি আসে। রাকিবের মা সালমা খাতুন দুপুরে ছেলের বাড়ি আসা একদমই পছন্দ করেন না। রাকিবরা দুই বোন একভাই, বাবা পাঁচ বছর আগে মারা গেছেন।
বোনদুটোরই বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়িতে রাকিব, রাকিবের মা আর নতুন বউ ছোটোখাটো সংসার। দুপুরে বাড়ি ফিরে রাকিব নতুন বউকে উদ্দেশ্য করে বলল,সেতারা রান্না হয়েছে? ভাত দাও। সেতারা নতুন বউ সেজন্য সালমা খাতুন বৌমাকে রান্না করতে না দিয়ে নিজে রান্না করছেন। সেতারা রান্নাঘরে যেয়ে শ্বাশুড়িকে আস্তে করে বলল,আম্মা রান্না হয়েছে? আপনার ছেলে ভাত চাচ্ছে।
সেতারার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে সালামা খাতুন হাতের খুন্তি ফেলে দিয়ে রান্নাঘরের বাইরে এসে রাকিবকে উদ্দেশ্য করে রাগী গলায় বললেন,খুব বউ চিনেছিস মনে হচ্ছে! এতকাল মা’র কাছে ভাত চেয়েছিস আর দুইদিন বিয়ে নাই করতে মা পর হয়ে গেল? এখন মা’র থেকে বউ বেশি আপন হলো! যা আমি আর এই সংসারের কোন ব্যাপারে আর নেই, তোর বউকে বল সংসার বুঝে নিয়ে রান্নাবাড়া করতে।
ঘটনার আকস্মিকতায় সেতারা থতমত খেল।রাকিব আমতা আমতা করে বলল,মা বড্ড ভুল হয়েছে এরকম ভুল আর হবে না। আসলে সেতারা সামনে ছিল তাই মুখ ফস্কে ওকে ভাত দেওয়ার কথা বলে ফেলেছি আর কোনোদিনও বলবো না মা।
রাকিব সকালে যখন দোকানের উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয় সেতারা সদর দরজার কাছে এসে রাকিবকে বিদায় দেয়। সালমা খাতুন দেখতে পেয়ে সেতারাকে বললেন,এসব কি বৌমা! রাকিব বাইরে যাচ্ছে আর তুমি সদর দরজার কাছে যেয়ে বিদায় জানাচ্ছ! এসব ন্যাকামি একদম করবে না। গ্রামের লোকজন দেখতে পেলে কি ভাববে? তারা বলবে রাকিবের বউয়ের লাজ লজ্জা কিচ্ছু নেই।
সেতারা আর কোনোদিনও রাকিবকে বিদায় জানাতে সদর দরজায় যায় না। সন্ধ্যার পর রাকিব বাড়ি ফিরে আশেপাশে সেতারাকে দেখতে না পেয়ে সেতারা বলে ডাক দিলো। ঘরে সালমা খাতুন তার প্রতিবেশী জায়ের সাথে গল্প করছিলেন রাকিবের গলা কানে যেতেই জোরে জোরে বলে উঠলেন,বুঝলে বুবু আজকাল ছেলে আর বৌদের লজ্জা শরমের বালাই নেই। আমাদের সময় কখনোই স্বামী আমাদের নাম ধরে ডাকত না আর এখন মুরব্বিদের সামনেই কেমন বউয়ের নাম ধরে ডাকে আহ্লাদ করে! রাকিব আগে বাড়ি ফিরলে মা বলে ডাক দিতো আর এখন বউয়ের নাম ধরে ডাকে!
সেতারা পাশের ঘর থেকে শ্বাশুড়ির কথা শুনে লজ্জায় লাল হয়ে গেল।রাকিব ঘরে ঢুকতেই সেতারা ফিসফিস করে বলল, তুমি আর আমাকে নাম ধরে ডাকবে না আর আম্মার সামনে আমার সাথে বেশি কথা বলার দরকার নেই । আচ্ছা সে দেখা যাবে এখন এটা নেও বলেই রাকিব হাসি মুখে একটা কাগজের ঠোঙা সেতারার দিকে বাড়িয়ে ধরলো। কি আছে এতে বলতে বলতে সেতারা হাসিমুখে ঠোঙাটা নিয়ে খুলে দেখে ওর ভিতর একটা লিপস্টিক, একজোড়া সিটি গোল্ডের কানের দুল, একটা চেন আর একপাতা টিপ। খুশিতে সেতারার চোখ চকচক করে উঠল। পরেরদিন সেতারার কানে দুল দেখে সালামা খাতুন জিগ্যেস করলেন, নতুন দুল পরেছো দেখছি রাকিব এনে দিয়েছে? জি আম্মা গতকাল রাতে এনেছে।
সালমা খাতুন চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন এজন্য বলে নিজের মেয়ে আর পরের মেয়ে! আমার মেয়েরা সামান্য একটা টিপ কিনলেও আগে আমাকে দেখাবে আর তুমি আমাকে দেখানোর প্রয়োজন মনে করলে না। সেতারা লজ্জায় তাড়াতাড়ি ঘরে যেয়ে বাকি জিনিস নিয়ে এসে শ্বাশুড়িকে দেখিয়ে বলল, আম্মা দেখেন এগুলো আপনার ছেলে কিনে দিয়েছে। ঐসব দেখে আমি কি করবো? আমাকে তো দেখাতে না, আমি বললাম তাই দেখাচ্ছ। আমার ছেলের এখন কত গুণ হয়েছে! বাজার থেকে বউয়ের জন্য সাজগোজের জিনিস কিনে আনে অথচ আমার মেয়েদের জন্য কোনোদিনও একটা মাথার ক্লিপও কিনে আনেনি। তোমাকে কিনে দিয়েছে তুমি পরো বলেই সালমা খাতুন রাগী মুখে উঠে চলে গেলেন।
লজ্জায় দুঃখে সেতারার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে মনে মনে বলল, উনাকে বলবো আর কোনদিনও যেন আমার জন্য কিছু কিনে না আনে। রাকিবের বন্ধু সোহেল নতুন বিয়ে করে বউ নিয়ে কক্সবাজার থেকে বেড়িয়ে এসেছে। রাকিবেরও খুব ইচ্ছা হলো সেতারাকে সাথে নিয়ে কক্সবাজার যাবে। রাতে ভাত খেতে খেতে সাহস করে রাকিব মা’কে কক্সবাজারে বেড়ানোর নাম করতেই সালমা খাতুন ঝাঁঝিয়ে উঠলেন,খবরদার রাকিব ফালতু পয়সা খরচ করবি না। আড়চোখে সেতারার দিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন নিশ্চিয়ই বউ কক্সবাজারে বেড়াতে যাওয়ার কথা বলতে শিখিয়ে দিয়েছে?বউকে বল বাপের বাড়ি থেকে টাকা এনে তারপর যেন বেড়াতে যাওয়ার নাম করে।
ঘরে ঢুকে সেতারা রাকিবের উপর রাগ দেখাল,আমি কখনও তোমাকে বলেছি কক্সবাজার বেড়াতে যাব? শুধু শুধু আম্মাকে বেড়ানোর কথা বলে আমাকে কথা শোনালে! আমি তোমার সাথে কোনেদিনই কোত্থাও বেড়াতে যাবো না।
এভাবে প্রতি পদক্ষেপে বাধাঁ পেয়ে রাকিব আর সেতারার সম্পর্কে একটু একটু করে দুরত্ব তৈরি হলো সময়ের সাথে সাথে সেই দুরত্ব অনেকখানি বেড়ে গেল। সেতারার এখন দুই ছেলে,ছেলেরা বড় হয়েছে। শ্বাশুড়ি মারা গেছেন তবুও রাকিব আর সেতারার নাম ধরে ডাকতে পারে না। এমনকি সেতারার কাছে ভাতও চাইতে পারে না। সেতারা মিটসেফের ভেতর ভাত তরকারি রেখে দেয় রাকিব নিজের মতো বের করে খায় নইলে রাকিবের মিটসেফ খোলা দেখলে সেতারা ছুটে এসে ভাত বেড়ে দেয় অথবা রাকিব বাড়িতে পা দেওয়ার সাথে সাথে সেতারা ভাত বেড়ে অপেক্ষা করে।
আশেপাশের চাচাত দেবররা যখন বউদের নাম ধরে ডাকে সেতারার বুকের ভেতর হুহু করে ওঠে স্বামীর মুখে নিজের নাম খুব শুনতে ইচ্ছা করে। লজ্জা বাদ দিয়ে সেতারা একদিন রাকিবকে বলল,এখন তো তুমি আমাকে নাম ধরে ডাকতে পারো?
রাকিব করুণ হেসে বলল,কি যে বলো! সেই সাতাশ বছর আগে নামটা মুখে আটকে গেছে আর বের হবে না। সেতারার বড় ছেলে আকাশের সাথে অবন্তীর সদ্য বিয়ে হয়েছে।সেতারা সব সময় চায় সেতারা যে কষ্ট সহ্য করেছে অবন্তীকেও যেন একই কষ্ট সহ্য করতে না হয়। বিয়ের তিনদিন পর সেতারা নিজের ঘরে আকাশকে ডেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বলল,বাবা এতদিন আমার কাছে ভাত চেয়েছিস এখন থেকে বৌমার কাছে ভাত চাইবি। তার তো ইচ্ছা করবে নিজের হাতে স্বামীকে ভাত বেড়ে খাওয়াতে।
সবসময় বৌমার নাম ধরে ডাকবি আমাদের সামনে কোনো লজ্জা করবি না। বৌমাকে সাথে নিয়ে বাজারে যেয়ে পছন্দের জিনিস কিনে দিবি আর খুব তাড়াতাড়ি বৌমাকে নিয়ে দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার ব্যাবস্হ্যা কর। নব দম্পতির একটু আলাদাভাবে বেড়ানোর খুব দরকার। আকাশ বাধ্য ছেলের মত মা’র সবকথা শোনার প্রতিশ্রুতি দিলো। সেতারা মনে মনে খুব খুশি হলো। সেতারা নিজের জীবনে যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে সে কোনোভাবেই চায় না তার বৌমাও সেই একই পরিস্থিতিতে পড়ুক।
তার আর রাকিবের জীবনে কোনো অভাব অভিযোগ ঝগড়াঝাটি নেই, নিজেদেরকে সুখী ভাবলেও কোথায় যেন দুরত্ব ঠিকই আছে।প্রথম জীবনে তিলে তিলে সেতারা আর রাকিবের মধ্যে যে দুরত্ব তৈরী হয়েছিল সেটা এতো বছরেও কোনোভাবেই অতিক্রম করতে পারেনি। সেতারা কখনোই চায় না আকাশ এবং অবন্তীর জীবনে একই দুরত্ব তৈরি হোক।