চাকরি করার ইচ্ছে আরও দুুবছর আগেই মাটিচাপা দিয়েছি। তাই আর চাকরির কথা ভাবি না, পরিবারের সবার মুখ থেকে এই কথা শুনতে শুনতে জীবনটা তেনাতেনা হয়ে গেছে। যে যাই বলুক চাকরি আমি করবো না। মাস্টার পাশ করে বসে আছি। ভাইয়াকে মা বলত, কিরে সুমন নিজের ভাইয়ের কন্য একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিলেই তো পারিস। মা তুমি কেন বুঝো না, আমি কি কম বলছি ওকে? ওর কোনো ইচ্ছে নাই চাকরির প্রতি। বসের কাছে ওর জন্য আমার অনেক ছোট হতে হয়েছে, আর আমি পারবো না। বলেই ভাইয়া অফিসের জন্য বের হয়ে পড়ল।
ঠিকই বলেছে, আমার জন্য সবারই সম্মানহানি হয়েছে এই পরিবারের। খাবার টেবিলে বসে গোগ্রাসে গিলছিলাম আমি। তোর ভিতর কি কোন মনুস্বস্তবোধ নাই নাকি রে? মা বলল। আর কতোদিন এইভাবে চলবি? আলসেমি ছাড় এখন।তোর বিয়ে দিলে বোধ হয় তুই ঠিক হবি তুই, বেকার ছেলের হাতে কেই বা মেয়ে দেবে শুনি? কেউ দেবে না তোর হাতে মেয়ে। একা একা বোকেই যাচ্ছেন উনি, খাবারটা শেষ করে নিজের রুমের মধ্যে এসে বসলাম, চাকরি করবো না আমি, তাতে কেউ মেয়ে দিলে দেবে না দিলে নাই। বিয়ে করলে তো বউয়ের চিল্লাপাল্লা আছেই, যা ভাইয়া-ভাবির রেগুরাল রুটিন এর একটা।
ভাবতেই নিজের মধ্যে কেমন জানি করে উঠল। গল্প বই নিয়ে বিছানায় শুয়ে আছি,তাও পড়তে ভাল লাগছে না সারাদিন আর কোনো কিছু করার নেই। বাসায় মা,ভাইয়া ভাবি এর আমি থাকি। বাবাকে ছোট বেলায়ই হারিয়েছি আমরা। ভাইয়ার বিয়ে হয়েছে এক বছরও হয় নাই,তো বাচ্চা হওয়ার প্রশ্নই আছে। দুপুরে ঘুম ভাঙ্গলো বৌদির ডাকে। উঠে গোসল করে খাবার টেবিলে গেলাম। শুনি বৌদি বাপের বাড়িতে যাবে, সাথে মাও যাবে। বললাম রান্নাবান্না কে করবে শুনি? বৌদি বলল,কেন আপনি আছেন না রান্না করার জন্য,এই কাজটা আপনিই কইরেন। বল্লেই খিলখিল করে হেঁসে উঠল। বৌদির নাম উর্মি। আমাকে আপনি করেই ডাকে সবসময়। ওনার কথা শুনে রাগে খাবার টেবিল থেকে উঠে আসলাম।
রুমে এসে শার্ট পেন্ট পরে বাইরে বপর হওয়ার সময় মা বলল,কিরে কোথাই যাচ্ছিস? ভাবি বলল, বোধহয় সবজি কিনতে যাচ্ছে। বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলেন। রাগে মাথার চুল ছেঁড়ার ইচ্ছে হচ্ছে আমার। একটা চায়ের দোকনে গিয়ে বসলাম। আচ্ছা চাকরি না করলে কিসের এতো প্রবলেম ওনাদের ভাবতেই রাগে গা জ্বালা করছিল আমার। থাকবোই না এ বাসাতে। বাসায় এসে দেখি বাসা ফাঁকা। বুঝলাম বাপের বাড়ি গেছে। রাতে ভাইয়া আসলো,কিরে, মুখ কালো করে বসে আছিস কেন? ভাইয়া বলল, কিছ বললাম না আমি। একটু পরে বললাম আমি কোথাও ঘুরে আসতে চাই, ভাইয়া মুচকি হাঁসি দিয়ে বলল, টাকা আছে। চুপ করে থাকলাম, আচ্ছা তো কবে যাবি? কালকেই,বললাম আমি। সকালে অফিসে যাওযার সময় তোর একাউন্টে টাকা দিয়ে দিবো আমি বলেই ভাইয়া চলে গেল। পরেরদিন ঘুম থেকে উঠলাম ১২ টায়।
ব্যাচেলরের ঘুম বলে কথা। ফ্রেশ হয়ে জামা কাপড় ব্যাগে ভরলাম। ফোন ধরতেই দেখি ভাইয়ার ম্যাসেজ। কক্সবাজারের হোটেলের টিকিট বুকিং দেয়েছি তোর জন্য, আর টাকাও দিয়ে দিয়েছি তোর একাউন্টে। ভাল মতো যাও। আমি বাসা থেকে বের হয়ে বাস টার্মিনালে গেলাম। টিকিট কাটা শেষ, বাসে উঠতেই দেখি বাস ছাড়লো। বসে আছি, ঘুম পাচ্ছে না। কিছুদুর গিয়ে বাস থামিয়ে একজন যাত্রী উঠাল। সাদা শারী পড়া, হাতে লাল চুড়ি হাতে তেমন ভারী ব্যাগ দেখলাম না। হয়ত বক্সে রেখেছে। আমার পাশের সিটটা ওনার। মেয়েতে আমার এলার্জি ছোট বেলা থেকেই। তাই জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকলাম। হাই, আমি ফারিয়া,আপনি? আমি না ঘুরেই বললাম রাকিব। মেয়েটি বলল, কোথায় যাচ্ছেন? আমি বললাম,কক্সবাজার। তো কি করেন আপনি? প্রশ্নটি শুনে চুপ করে রইলাম। হ্যালো!! কিছু জিগ্যেস করছিলাম আপনাকে, মেয়েটি বলল। আমি বললাম বেকার। মেয়েটা খিলখিল করে হেসে উঠল। আমি উনার দিকে তাকাতেই হাসি থেমে গেল, মনেহয় ভয় পেয়েছে।
আমি ঘুরতেই আবার খিলখিল করে হেঁসে উঠল মেয়েটা। মন চাচ্ছে জানালা দিয়ে লাফিয়ে নেমে যাই। বেকারের মধ্যে কি এরা জোকার দেখতে পায় নাকি আল্লাহই জানে। কোথায় থাকি, বাসায় কে কে থাকে, সারাদিন কি করি এমন প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন উনি। সাইকো নাকি, মনে মনে বললাম, ওনার প্রশ্নের হাত থেকে বাঁচার জন্য ঘুমের ভান ধরলাম। উনি উওর না পেয়ে হাতের কনুই দিয়ে একটু ঠ্যালা দিলো আমাকে।কি অসভ্য মেয়েরে বাবা! অচেনা ছেলের সাথে এমন বিহেইভ করছে যেন আমি তার স্বামী। মনে মনে বললাম, চোখ খুললাম না। ঘুমের অভিনয় করতে গিয়ে সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছি আমি। পানি তেষ্টায় ঘুম ভেঙ্গে গেল, উঠে দেখি আমার কাঁধে মাথা রেখে দিব্যি ঘুমুচ্ছেম মেয়েটি। মাথাটা কাঁধ থেকে নামিয়ে দিতেই উনার ঘুম ভেঙ্গে গেল। সাথেসাথেই আমার হাঁত সরিয়ে নিলাম। ব্যাগ খুলে পানি খেয়ে বোতলটা রাখতে যাবো,তখন উনি বলল, আমিও খাবো।
মুখ লাগিয়ে পানি খাওয়া আমার ছোট বেলার অভ্যাস,তাই নতুন আরেকটি বোতল বের করে উনাকে দিলাম। ওমা, এদেখি উনিও মুখ লাগিয়ে খাচ্ছে। খুব রাগ হলো। পানি খাওয়া শেষ করে বোতলটা আৃার দিকে আগিয়ে দিলো। আমি বললাম আপনি রেখে দিন,আমার লাগবে না। আরে লাগবে লাগবে বলে আমাকে চোখ মারলো, কি অভদ্র মেয়েরে বাবা, কেন যে আসতে গেলাম কে জানে! বোতলটা নিয়ে জানালা দিয়ে ফেলে দিলাম। মেয়েটা হেসে উঠল, বাবা একটু পানি খেয়েছি তার জন্য বোতলটা ফেলে দিলেন? কিছু বললাম না ওনাকে। ফোন বের করে ফেসবুকে ঢুকলাম, নোটিফিকেশন চেক করে আমার একটা ছবির কমেন্টসে্র রিপ্লে দেওয়ার সময় পাশ থেকে মেয়েটা বলল, বাবা! বেকার ছেলে কোর্ট-টাই পড়ে কোথায় গিয়েছিলেন? বিয়ে করতে নাকি? আচ্ছা আপনার প্রবলেমটা কি প্লিজ একটু বলবেন? বললাম আমি। আমার প্রবলেম হচ্ছেন আপনি, উওরে বলল মেয়েটি। আমি আপনার প্রবলেম হতে যাবো কেন? এইযে আমি আপনার সাথে কথা বলছি, আর আপনি ঠিকমতো উওর দিচ্ছেন না যে তাই আপনি আমার প্রবলেম। কেন যে এই বাসটাতেই উঠতে গেলেম! নিজেকেই দোষারোপ করলাম আমি।
বাস থামলো ১৫ মিনিটের জন্য। নামলাম আমি। একটা সিগারেট খেয়ে এসে দেখি আমার সিটে একটা পানির বোতল। মেয়েটা হয়ত কিনে এনে রাখছে। চুপচাপ বসে রইলাম। বাস ছাড়ার সময় হয়ে আসলো,মেয়েটা বাসে উঠছে না। চিন্তা হচ্ছিল একটু একটু।পরে ভাবলাম না উঠতে পারলেই ভাল,বকবক তো আর শোনা লাগবে না। ইন্জিন স্টাস্টের সময় উঠল মেয়েটা। এসে বসতেই জিগ্যেস করলাম, কোথায় গেছিলেন আপনি?
কেন খুজছিলেন না আমাকে,বলেই একটা ছোট্ট হাসি দিলো মেয়েটা। লজ্জা লাগলো একটু। কিছু না বলে বাইরের গাছপালার দিকে তাকিয়ে আছি। বাস চলছে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে। আপনার গার্লফ্রেন্ড নাই তা আমি জানি, মেয়েটা বলল।কে বলেছে আপনাকে যে আমার গার্লফ্রেন্ড নাই? মেয়েটি বলল, এমন বোরিং ছেলের গার্লফ্রেন্ড থাকতেই পারে না,তার উপর আবার বেকার। বলেই হেসে উঠল মেয়েটা। আমি চুপ করে আছি। ও স্যরি স্যরি, আপনাকে তো বেকার বললে আপনি ট্রাগ করেন বলেই আবার হেসে উঠল আবার। কখন এর হাত থেকে রেহাই পাবো আল্লাহই জানে। লেখাটির দ্বিতীয় পর্ব আসিতেছে…